অন্ধকারের রাজকুমার ও তার ‘হাওয়া ভবন’

1 min read

তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিএনপি-জামায়াত সরকারের ২০০১-০৬ মেয়াদে দুর্নীতি এবং সহিংসতার পরিস্থিতি তুলে ধরে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা সম্প্রতি দাবি করেছেন, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার “হাওয়া ভবন”-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতার সব অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।

সম্প্রতি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে উল্লেখ করেন।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশো’তে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো রাজনৈতিক অপ্রচারের অংশ। কোনো প্রমাণ বা নথি কিছুই নেই। এত বছর সরকার (অভিযোগ প্রমাণ করতে) কী করেছে?” এ সময় তিনি বর্তমান সরকারের আমলে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন।

সম্প্রতি বিএনপির কার্যনির্বাহী পরিষদের আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের একটি ইউটিউব টকশো’তে বলেছেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নিয়মিত “হাওয়া ভবন” অফিসে যেতেন।তবে এই অফিসে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু ঘটেনি।

তিনি বলেন, “এটা মিডিয়ার সৃষ্টি… যারা বিএনপিকে অপছন্দ করে, এটা তাদের অপপ্রচার। এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। আমি স্বীকার করি যে, অনেক মামলা হয়েছে। কিন্তু, এগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এসব মামলায় সঠিক তথ্য প্রমাণ ছাড়াই রায় দেওয়া হচ্ছে।”

তবে, বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং মিডিয়া বিভিন্ন সময়ে বলেছে যে, ২০০১-০৮ সালে তারেক রহমান এবং তার দুর্নীতিগ্রস্ত সহযোগীরা “হাওয়া ভবন”কে বিকল্প “পাওয়ার হাউস” হিসেবে ব্যবহার করেন। যেখান থেকে দেশ পরিচালনা ও আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।

২০০৫ সালে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। বিএনপি সরকারের ওই মেয়াদকালে, সরকারি দুর্নীতিকে দায়ী করে বিশ্বব্যাংক তাদের তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল বাতিল করে। এই সময়ে দুর্নীতি বিষয়ে প্রতিবেদন করায় সরকারি বাহিনী, সন্ত্রাসী ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের দ্বারা আক্রমণ ও হয়রানির শিকার হন অসংখ্য সাংবাদিক।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজধানীর বনানী ১৩ নম্বর রোডে “হাওয়া ভবন” নামে একটি ভবনে তার রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপন করেন। ভবনটি তার বড় ছেলে তারেক রহমান নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহার করতেন।

প্রবেশদ্বারে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত ভবনটি দ্রুতই দুর্নীতিগ্রস্ত সহযোগীদের দ্বারা “অন্ধকারের রাজকুমারে”র তোষামোদের জন্য সরকারের “পাওয়ার হাউস” হিসেবে পরিণত হয়। দ্রুতই এটি লাগামহীন দুর্নীতি, নির্মম প্রতিহিংসা, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে জর্জরিত হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, মা এবং তার দুই ছেলেসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হন। আর এসব দুর্নীতির কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়।

হাওয়া ভবনে ‘বিপজ্জনক’ তারেক

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী “হাওয়া ভবন”কে “উইন্ড টানেল” হিসেবে উল্লেখ করেন।

২০০৫ সালের ১৪ মার্চ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাপকালে তারেক রহমানকে “অপরিশীলিত এবং বিপজ্জনক” বলে উল্লেখ করেন তিনি। সেই সময়ে তিনি উল্লেখ করেন, নিজের অনভিজ্ঞতার কারণে তারেক রহমান হাওয়া ভবনে কিছু অসাধু বন্ধুদের সহযোগিতা নিতেন।

সেই সময়ে কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীকে রাষ্ট্রদূত জানান, মার্কিন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করার জন্য তারেক রহমান অনুরোধ প্রটোকল এবং অন্যান্য কারণে বাস্তবায়ন করা যায়নি।

কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, “পারিবারিক রাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।” নিজের দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলেকে প্রশয় দেওয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার “সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা” হিসেবে বর্ণনা করেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী।

দুর্বল মানবাধিকার

তারেক রহমানকে গ্রেপ্তারের আগে ও পরে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হারিস চৌধুরী এবং গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের মতো অসাধু সহযোগীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

কখনো রাজনীতিতে না জড়ানোর শর্তে জেল থেকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পর তারেক রহমান ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে চলে যান, তারপর থেকে সেখানে বসেই দল পরিচালনা করছেন।

মার্কিন দূতাবাসের একটি সূত্র বলেছে, সেই সময়ে গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জামিন পেয়েছিলেন তারেক রহমান।

প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেছেন, “সরকারি ক্রয় কার্যক্রম এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়ার জন্য তারেক রহমান বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি এবং সহিংস রাজনীতির প্রতীক।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, আওয়ামী লীগ সমর্থক, হিন্দু ও আহমদিয়া সম্প্রদায়, নারী, সাংবাদিক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলের প্রান্তিক জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

অ্যামনেস্টি বলেছে, বেশ কয়েকটি বোমা হামলাসহ ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা সেই সময়ে বাংলাদেশকে মানবাধিকার সংকটের শেষ প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনজিও এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য দুটি জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি এবং জেএমজেবি’কে নিষিদ্ধ করেছিল সরকার।

এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছিল। দেশটি সারা বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই বোমা হামলা দেখেছে। যার মধ্যে ৬৩ জেলায় একযোগে বিস্ফোরণের ঘটনাও হয়েছে, যার সবগুলোই জেএমবি কর্তৃক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছিল।

সেই সময়ে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠীটি বলেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বল প্রয়োগ এবং হেফাজতে নির্যাতনসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। প্রতিবাদ করা মানবাধিকার কর্মী এবং এসব বিষয়ে প্রতিবেদন করা সাংবাদিকদের হয়রানিও ভয় দেখানো হচ্ছে।

নিষেধাজ্ঞা

২০০৮ সালের নভেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে দেশটির “অভিবাসন ও জাতীয়তা” আইনের ধারা ২১২ এবং প্রেসিডেন্টের ঘোষণা ৭৭৫০ এর অধীনে নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মতামত চেয়েছিলেন।

কয়েক ডজন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সঙ্গে তারেক রহমান সরসারি জড়িত উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, “তারেকের ‘প্রকাশ্য দুর্নীতি’ মার্কিন মিশনের নির্দিষ্ট লক্ষ্যকেও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জন্য মার্কিন দূতাবাসের তিনটি প্রধান অগ্রাধিকার রয়েছে- গণতন্ত্রীকরণ, উন্নয়ন, এবং সন্ত্রাসীদের স্থান না দেওয়া। তারেকের দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড তিনটি বিষয়কেই বিপন্ন করে তুলেছে।”

মরিয়ার্টি আরও বলেন, “তার অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করেছে; যা একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মার্কিন লক্ষ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ।তারেকের দুর্নীতির চর্চা এবং ঘুষ লেনদেনকে উৎসাহিত করার প্রবণতা বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে, যার ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মার্কিন প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে।”

“আইনের শাসনের প্রতি তার স্পষ্ট অবজ্ঞা সন্ত্রাসবাদীদের বাংলাদেশে পা রাখার জন্য শক্তিশালী জায়গা তৈরি করেছে, সেইসঙ্গে দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশে যা কিছু অন্যায় অবিচার ঘটছে তার বেশিরভাগের জন্য তারেক এবং তার সহযোগীদের দায়ী করা যেতে পারে। ”

মরিয়ার্টি পরামর্শ দিয়েছিলেন, যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১২ ধারার প্রয়োগ বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানকে সমর্থন করে। দূতাবাস সুপারিশ করে, প্রেসিডেন্টের ঘোষণা ৭৭৫০ এর ধারা ১, অনুচ্ছেদ (সি) এর অধীনে তারেক রহমানের সরকারি দুর্নীতি সংজ্ঞায়িত করা যায়।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours