বিএনপিতে কোণঠাসা ত্যাগীরা, চলছে বিদ্রোহ

1 min read

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপিতে গতিশীল নেতৃত্ব বাছাইয়ে ‘সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা’ হাতে নেয় হাইকমান্ড। তৃণমূলসহ অঙ্গদলগুলো শক্তিশালী করতে আলাদা ‘সার্চ কমিটি’ও করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘সরকারের প্রতিবন্ধকতা’ উপেক্ষা করে তৃণমূলে সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন। কিন্তু গ্রুপিং রাজনীতির কারণে অনেক ইউনিটে কমিটি গঠনের সক্ষমতা থাকলেও তা আর হয়নি। কেন্দ্র থেকে আহ্বায়ক কমিটি চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ ‘পকেট’ কমিটি নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কোথাও কোথাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। শুধু বিএনপিই নয়, দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোতেও গ্রুপিং রাজনীতির শিকার হচ্ছেন ত্যাগীরা।

অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের কোণঠাসা করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের পছন্দে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের ঢাকায় ডাকেন। একতরফা কমিটি করেন। তদবির-লবিংয়ের মাধ্যমে ‘সুপার ফাইভে’ জায়গা করে নিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা। ফলে ত্যাগী, যোগ্য ও পরীক্ষিত অনেকেই বাদ পড়ে যাচ্ছেন। প্রভাবশালীদের ‘নয়ছয়ে’ আবার কোনো কোনো কমিটির পুনর্গঠনও আটকে যাচ্ছে।

বিএনপির দফতর সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জুনে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে ১৭টির মতো জেলায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো অর্ধেকের মতো কাজ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ময়মনসিংহ মহানগর, ময়মনসিংহ উত্তর ও দক্ষিণ, নেত্রকোণা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনী, পঞ্চগড়, নীলফামারী, সৈয়দপুর, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর সাংগঠনিক জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মানিকগঞ্জ ও নীলফামারীতে সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

অঙ্গদলগুলোতেও কমিটি গঠন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া যে দুই-একটা সংগঠন কিছু ইউনিট কমিটি ঘোষণা করে। তাতেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নেতাকর্মীদের পদায়ন করা হচ্ছে। ফলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগর। এ কমিটি নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রভাবশালী নেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে কমিটি ঘোষণা বিলম্বিত হচ্ছে।

জানা গেছে, মহানগর কমিটি নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক প্রভাবশালী নেতা আলোচনা করেন। এক নেতার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যানের ‘সায়’ থাকলেও বিএনপিপ্রধান তাকে চাচ্ছেন না। তার পছন্দ তরুণ নেতৃত্ব। ফলে দুই দফা কমিটি চূড়ান্ত করা হলেও ঘোষণা হচ্ছে না। আবার কেউ বলছেন, চেয়ারপারসনের সম্মতি নিয়েই মহানগর কমিটি ঘোষণা করা হবে। তিন-চার দিন হলো দায়িত্বশীল এক নেতার কাছে কমিটি জমা আছে। যে কোনো সময় ঘোষণা আসতে পারে।

ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন হচ্ছে বলে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীরাও অবগত। ঢাকা মহানগর বিএনপিকে দুই ভাগ করে সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল। দলের ‘ভ্যানগার্ড’ খ্যাত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাই করা হলেও দুই বছরে তারাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি। আর মাত্র দুই মাস পরই এই সহযোগী সংগঠনটি মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। এছাড়া প্রায় দেড় বছর আগে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে যুবদলের। একই অবস্থা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলেরও। এ সংগঠনেরও মেয়াদ শেষ হয়েছে অন্তত দুই বছর আগে। ছাত্রদল ছাড়া বাকি বিএনপির ১০টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। এদিকে কাউন্সিল করে প্রায় ছয় মাসেও কমিটি দিতে পারেনি জাতীয়তাবাদী কৃষক দল।

বিএনপির অঙ্গসংগঠন ৯টি আর সহযোগী সংগঠন দুটি। এসবের মধ্যে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল মেয়াদ শেষ করেছে সুপার ফাইভ কমিটি দিয়েই। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আংশিক কমিটি ঘোষণা করে এ দুই অঙ্গসংগঠন। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। বয়সের সীমা বেঁধে দিয়ে গঠিত সংগঠনের নতুন কমিটিকে গতিশীল করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান। কিন্তু ছাত্রদলের সুপার ফাইভসহ সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেন, বলয় রাজনীতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান কমিটির মেয়াদ সেপ্টেম্বরে শেষ হতে যাচ্ছে।

ছাত্রদল সূত্র জানায়, সদ্য ঘোষিত মহানগরীর চার ইউনিট কমিটি গঠন নিয়ে আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। তবে বর্তমান নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে না পারলেও প্রথমবারের মতো পৌর, উপজেলা ও কলেজ শাখায় ১ হাজার ৪৩১টির মতো কমিটি দেওয়া হয়েছে। সমমর্যাদার মাত্র দুই শতাধিক কমিটি গঠন বাকি আছে। তবে ১৪৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ঢাকা জেলা উত্তর, ঢাকা জেলা দক্ষিণ, খুলনা মহানগর, চট্টগ্রাম মহানগর, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী ও টাঙ্গাইল জেলার আহ্বায়ক কমিটি দিতে পেরেছে ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব। এছাড়া ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৯টি মেডিকেল কলেজ শাখার কমিটিও হয়েছে বলে জানা গেছে।

শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, তর্ক-বির্তকের মধ্য দিয়ে যাচাই-বাছাই করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। অনিয়মের কোনো ভিত্তি নেই। কেউ পদ না পেলেই নানা অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, যোগ্যরাই কমিটিতে পদায়ন হন। আবার যোগ্যরাই বাদ পড়ছেন। একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কমিটি গঠন করা হয়।

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সুপার ফাইভ কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে বিগত দিনের সাবেক ছাত্রদল নেতাদের পদায়ন সম্ভব হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে ঘোষণা করা হবে, তা জানা যায়নি। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কমিটিতে সংগঠনের সভাপতি করা হয় প্রয়াত শফিউল বারী বাবুকে। সাধারণ সম্পাদক হন আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর সুপার ফাইভ কমিটিকে ১৪৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে পরিণত করে আংশিক কমিটি করা হয়েছে। এরপর আরেক দফায় ১০ জনকে সদস্য ও কিছু উপদেষ্টা ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে কমিটি এখন ১৭২ সদস্যবিশিষ্ট। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে সারা দেশে সাংগঠনিক ৮১টি জেলার প্রায় সবটিরই কমিটি সম্পন্ন হয়েছে সংগঠনটির। এ ছাড়া ছয় শতাধিক জেলা ও থানার কমিটি হয়েছে। কয়েকটি সাংগঠনিক জেলা, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন থানা কমিটি গঠনে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘ ২২ বছর পর কৃষক দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের চার মাস পার হলেও কমিটি ঘোষণা হয়নি।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কৃষক দলের কমিটি ভেঙে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদুকে আহ্বায়ক এবং কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনকে সদস্য সচিব করে ১৫৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অজানা কারণে কমিটি ঘোষণা হয়নি। কেন কমিটি হচ্ছে না তা কেউ বলতে পারছেন না। এ ছাড়া মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল ও ওলামা দলের কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেসবের মেয়াদও শেষ হয়েছে অনেক আগে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো সংগঠনই কাউন্সিল করতে পারেনি। মহিলা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে শ্রমিক দলের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরও চার বছর আগে। বেশি কিছুদিন আগে শ্রমিক দলের এক প্রভাবশালী নেতাকে নিয়ে ধানমন্ডিতে এক অফিসে মিটিং করেন সংগঠনের নেতারা। ‘অজানা’ কারণে কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আর এগোয়নি বলে জানা শ্রমিক দলের এক শীর্ষ নেতা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘শ্রমিক সংগঠন ছাড়া দেশের কোনো সফলতা মুখ দেখেনি, আমরাও সফল হব না।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিকূল অবস্থায় দল পরিচালনা করছি। সরকারের বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই দল ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছি না। ভার্চুয়ালে নানা কার্যক্রম চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দলে কোনো সংকট নেই। করোনার কারণে কোনো কিছুই ঠিকটাক চলছে না। এছাড়া দেশে তো রাজনীতিই নেই। সুষ্ঠুভাবে সংগঠন করারও সুযোগ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তাই তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও নেই।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘দল থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তা আমরা পালন করে যাচ্ছি। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও করোনার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। এর মধ্যে অনেক ওয়ার্ড ও থানার কমিটি দিয়েছি। হাইকমান্ডের নির্দেশেই বাকিগুলো দেওয়া হয়নি। এখন যদি হাইকমান্ড মনে করেন নতুন নেতৃত্বে চলবে ঢাকা মহানগর, তা হলে আমরা সেই নির্দেশনা মেনে নেব।

+ There are no comments

Add yours