জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই

1 min read

গাজীপুরের আলোচিত বরখাস্তকৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বেপরোয়া আচরণ ও বিতর্কমূলক কর্মকাণ্ড যেন থামছেই না। টাকা আত্মসাত, জঙ্গি অর্থায়ন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতনসহ তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির ফিরিস্তি যেন শেষ হওয়ার নয়।

দল থেকে প্রথমে স্থায়ী বহিষ্কারের পর এবার দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী স্ত্রীও তাকে তালাক দিয়েছেন। মারধর ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাকে তালাক দেওয়ার কথা বলেন স্ত্রী। এখন স্থানীয় নেতাকর্মীরাও তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাজীপুরের বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে আবারও তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক জানায়, আগামী ৬ ও ৭ জুন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে বক্তব্য দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরের বক্তব্য নেয়ার জন্য দ্বিতীয় দফায় তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি এক মাসের সময় চেয়েছিলেন। সেই আবেদন বিবেচনায় নিয়ে তাকে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুদকসহ গাজীপুর-সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

যে কারণে তলব করেছে দুদক

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কতিপয় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরকে তলব করে দুদক। গত বুধবার দুদকের পক্ষ থেকে তাকে নোটিশ ইস্যু করা হয়। দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে ২০২০ সালের একটি অভিযোগ ও ২০২২ সালের আরেকটি অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এরই মধ্যে অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। অনেক কাগজপত্রও সংগ্রহ করা হয়েছে। অনুসন্ধানের শেষ পর্যায়ে এসে তার (জাহাঙ্গীর আলম) বক্তব্য প্রয়োজন। এ কারণে তাকে তলব করা হয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।

যে সব অভিযোগে অনুসন্ধানের শুরু

দুদক জানায়, কমিশন তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ পেয়ে গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য দুদকের এক কর্মকর্তাকে দিয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ওই কর্মকর্তা তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ ছাড়াও একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘ভুয়া অ্যাকাউন্টে মেয়র জাহাঙ্গীরের কোটি কোটি টাকা লেনদেন’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালের ২৫ মে প্রকাশিত সংবাদটি আগের অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। জানা গেছে, দুটি টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক আলী আকবর। আর টিমের অন্য দুই সদস্য হলেনসংস্থার সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন ও মো. আশিকুর রহমান।

অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট যে তথ্য সংগ্রহ

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের স্থানীয় শাখায় ‘মেয়র, গাজীপুর সিটি করপোরেশন’ নামে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। সেই হিসাব সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছে দুদক। এ ছাড়া অনুসন্ধান টিম গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। এসব বিষয়ে চার ব্যাংক কর্মকর্তা ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জনের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে।

সংগ্রহ করা অন্যান্য নথির মধ্যে, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন পূর্ত কাজের রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। হাটবাজার ইজারা ও অন্যান্য রাজস্ব খাত থেকে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে সে সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। কনজারভেন্সি খাতে কী কী কাজ হয়েছে বা কীভাবে অর্থ ব্যয় হয়েছে, মেয়র হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের কর্মকালীন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাজস্ব খাতভুক্ত যেসব ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়েছে সেগুলোর তথ্য, করোনা মহামারির সময়ে করোনা প্রতিষেধক ও খাদ্যসামগ্রী কেনার নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে কি না এসব বিষয়ে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার মাঠে বিভিন্ন খাতে ব্যয়-সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়াও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

দুদক আরও জানায়, এর বাইরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কয়েকজন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের একটি অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি টিম গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহসহ অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে।

দুদক জানায়, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আগামী ৬ ও ৭ জুন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়ে বক্তব্য দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরের বক্তব্য নেয়ার জন্য দ্বিতীয় দফায় তাকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

দুদক ও গাজীপুর-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে নিজের পছন্দের ১০ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই ভুয়া ভাউচারে বরাদ্দের পুরো অর্থ উত্তোলন করে নিয়েছেন তিনি। অনুসন্ধান নথিসূত্রে জানা গেছে, তিনি মেয়র থাকাকালে ২০১৮-২১ মেয়াদে ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন করেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকারি অর্থায়নের কাজ না করে ভুয়া কাগজপত্রে বাস্তবায়ন দেখিয়ে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারিতে প্রতিষেধক ও খাদ্যসামগ্রী কেনার নামে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ। বিশ্ব ইজতেমার মাঠ সংস্কারের নামে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ২২ হাজার ৫৫৮ টাকা। সিটি করপোরেশন ভবনের (নগর ভবন) লিফট এবং এসি স্থাপনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ৯৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া উন্নয়ন তহবিল থেকে রাজস্ব তহবিলে বেআইনিভাবে ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা স্থানান্তরসহ আত্মসাতের আরও অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে গত ২ মে তার বিরুদ্ধে আয়কর রিটার্নে সম্পদের তথ্য গোপন করায় দুদকে অভিযোগ দায়ের করেছেন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে গণফ্রন্ট মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম। অভিযোগে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতেও সম্পদ গোপন করার ও আয়-ব্যয়ের হিসাবে গরমিল লক্ষ করার কথা উল্লেখ করা হয়।

সরে গেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, জঙ্গি অর্থায়ন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতনসহ জাহাঙ্গীরের বেপরোয়া আচরণ ও বিতর্কমূলক কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই থামছে না। দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার, এমনকি স্ত্রীও তাকে তালাক দেন। এখন তার কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে চলাফেরা করা নেতাকর্মীরাও দূরে সরে যাচ্ছেন। এতদিন নির্বাচনি প্রচারে যারা অংশ নিয়েছেন তারা আর প্রচারে আসছেন না। দলীয় নির্দেশনাকে বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, বেপরোয়া আচরণ, নেতাকর্মীদের অসম্মান এবং দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে সবাই সরে যাচ্ছেন।

স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর ৭ দিন পর ২৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এরপর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দল সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে চলতি সিটি নির্বাচনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে দল থেকে মনোনয়ন দিলে জাহাঙ্গীর ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন। পরে যাচাই-বাছাইয়ে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়। এত কিছুর পরও দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে মায়ের পক্ষে নির্বাচনি কাজ করায় তাকে আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours