‘শহীদ জননীর কথাগুলো প্রেরণা দেয়’

1 min read

নিউজ ডেস্ক: শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে যমদূত। খানিক বাদেই হয়তো নিভে যাবে শহীদ জননীর স্বপ্নভরা দু’নয়ন। তবুও এতটুকু ভাবনা নেই নিজেকে নিয়ে। ভুলে যাননি আন্দোলনকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হাসপাতালে মৃত্যুর আগেও আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশ্যে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লিখে গেলেন তার শেষ বার্তা। হৃদয়ের জোরে লিখে গেলেন চরম সত্যটি। যা আজও আমাদের প্রেরণা যোগায়। আজ ২৫ বছরে এসে যার স্বাদ ভোগ করছি আমরা।

তার ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বার বার মনে পড়ছে সেই মর্মবাণী। শেষ বাক্যে তিনি লিখেছিলেন, ‘জয় আমাদের হবেই’।

প্রিয় জননীর ইচ্ছামত ঠিকই আমাদের জয় হয়েছে। বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে। স্বর্গে বসে হয়তো তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন তিনি।

জাতির জন্য রেখে যাওয়া শহীদ জননীর উপহার সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের দুই দশকেরও বেশি সময় পর যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে তখন কোথায় যেন শূন্যতা অনুভ‚ত হয়। পেছনে ফিরে পাই না নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রবল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার জাগরণ সৃষ্টিকারী জননীকে। নতুন দিনের নতুন প্রজন্ম আজ যুদ্ধপরাধীদের বিচার চান মনেপ্রাণে। তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ের মধ্যমণি জাহানারা ইমাম। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা থেকে গবেষক ও লেখক তাহমীদা সাঈদা জননীকে নিয়ে লিখেছেন ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম’ শীর্ষক গ্রন্থ। শোক চাপা দিয়ে জাহানারা ইমাম মেলে ধরেছেন উত্তাল দিনগুলোর মর্মকথা। তাতে ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি রয়েছে, তা যেন যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিটি মায়েরই আত্মকথা। ফলে একাত্তরের দিনলিপি সব মানুষেরই জীবনজয়ী অনুপ্রেরণার উৎস।

সংগঠক হিসেবেই বেশি আলোচিত জাহানারা ইমাম, সেটাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান, পাশাপাশি লেখক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু-কিশোরদের জন্য অতুলনীয় বহু গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি যেমন অনেক মৌলিক রচনা লিখেছেন, তেমনই অনুবাদ করেছেন প্রচুর। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা তো ঐতিহাসিক দলিল। তার স্মৃতিচারণমূলক রচনাগুলো অত্যন্ত উঁচুমানের।

রচনা করে গেছেন, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’, ‘প্রবাসের দিনলিপি’, ‘বুকের ভিতর আগুন’সহ অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সংগঠক জাহানারা ইমাম সারা দেশে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের দাবিতে তিনি যে জোয়ার তুলেছিলেন, এক কথায় তা ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে আমীর ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। শহীদ জননীর বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। ছেলেহারা মায়ের মুখে জেগে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদ জানাতে তিনি নেমে আসেন রাজপথে। তার সঙ্গে প্রতিবাদে নামে অসংখ্য দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ। তারপর সারা দেশেই শুরু হয় জনবিক্ষোভ। বিক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। এ সময় ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি।

তার নেতৃত্বে ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালত ১০টি অপরাধে গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। গণ-আদালতের সেই রায় কার্যকর করার দাবি নিয়ে তিনি নিজেই ছুটে যান সংসদে। স্মারকলিপি নিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার কাছে। ১০০ সংসদ সদস্য জনতার এ রায় সমর্থন করেন। সংসদে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে থেমে যাননি জাহানারা ইমাম। পরের বছরের ২৬ মার্চ গঠন করেন গণতদন্ত কমিশন। ঘোষিত হয় আরও আট যুদ্ধাপরাধীর নাম।

এরপর পার হয়েছে অনেক বছর। অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিতাসে। অনেক আশা-হতাশার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে একেকটি দিন। যুদ্ধাপরাধীরাও সংসদে তাণ্ডব নৃত্য দেখিয়েছে। ক্ষমতার মসনদে বসে মেতেছে নগ্ন উল্লাসে। সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এসেছে শহীদ জননীর শেষ বাক্য- ‘জয় আমাদের হবেই’।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours