এবার ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব

1 min read

নিউজ ডেস্ক: একাদশ সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা ঘরে-বাইরে প্রচন্ড চাপে পড়েছেন। বিশেষ করে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর চাপ সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা কর্মীদের কাছে জবাবদিহিতা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

গত বছর ৮ ফেব্রম্নয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দন্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। গত এক বছরেরও বেশি সময়ে সুদূর লন্ডনে বসে দল পরিচলনা করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে। সঙ্গত কারণে তারেক রহমানের পাশাপাশি স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হয়ে আসছে। এই যৌথ নেতৃত্বেই গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু চরম ফল বিপর্যয়ে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশা নেমে আসে।

নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও সরকারবিরোধী কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়া এবং শীর্ষ নেত্রীর মুক্তির জন্য কোনো উদ্যোগ সামনে না আসায় নেতাকর্মীদের মনে সন্দেহ অবিশ্বাস দেখা দেয়। দলের চেইন অব কামান্ডও ভেঙে পড়ে। বিভেদ বাড়তে থাকে। প্রকাশ্যে আসে সিনিয়র নেতাদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার বিষয়। বিভক্তি দেখা যায় স্থায়ী কমিটিতে। গুলশান ও নয়াপল্টনের কার্যালয়ের কার্মকান্ডেও সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টেও টানপড়েনের বিষয় সামনে আসে। সবমিলে একরকম বিশৃঙ্খল অবস্থা নিয়ে চলছে বিএনপির রাজনীতি।

বিএনপি সূত্রমতে, দলের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতাদেরই দায়ী করছেন। যৌথ নেতৃত্বে দল চলছে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সিনিয়র নেতারাই আছেন সবচেয়ে বেশি চাপে। কূটনৈতিক মহল এবং নির্বাচিতরা সংসদে শপথ নেয়ার চাপ দিচ্ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেকোনো মূল্যে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চাপ দিচ্ছেন। অঙ্গ দলসহ বিএনপিকে ঢেলে সাজাতে নতুন কমিটি গঠন এবং গণবহিষ্কারের প্রকৃত কারণ জানাতে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা চাপ দিচ্ছেন। এছাড়া ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে দলের একটি বড় অংশের চাপ আছে।

নানামুখী এসব চাপের বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, সংসদে শপথ নেয়ার পক্ষে যারা তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অধিকাংশ সিনিয়র নেতা শপথ নেয়ার বিপক্ষে। ফলে এ নিয়ে অসন্তোষ আছে।

শীর্ষ নেত্রীর মুক্তির চাপের বিষয়ে এই নেতা বলেন, নেতাকর্মীরা যেকোনো মূল্যে নেত্রীকে মুক্ত করার কর্মসূচি চাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কঠোর কর্মসূচি দেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। আর চেয়ারপারসন প্যারোলে মুক্ত হতে চান না। তাই এ সমস্যার সমাধান দেয়া খুবই কঠিন। এছাড়া সাংগঠনিক পুনর্গঠনের চাপের বিষয়ে বলা যায়, দল পুনর্গঠন এবং গণবহিষ্কারসহ দলের সাংগঠনিক কিছু বিষয় আছে, যা দলের নীতিনির্ধারকরাই জানেন না। কিন্তু যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হচ্ছে এই বিষয়টি সামনে থাকায় না জানার বিষয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। আর ঐক্যফ্রন্টে থেকে বেরিয়ে আসার যে দাবি আছে তা বর্তমান বাস্তবতায় পূরণ করা সম্ভব নয়।

স্থায়ী কমিটির এই নেতার মতে, দলের শীর্ষ নেতারা এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছেন। কারণ দলের হাইকমান্ড চাপ দিচ্ছে দলীয় শৃঙ্খলা ঠিক করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু এমন কিছু বিষয় আছে স্থায়ী কমিটির কেউ জানতেই পারছেন না। অথচ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরপরেও দলের বৃহত্তর স্বার্থে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। আর নিজেদের ইচ্ছামতো কেউ কিছু বললে রোষানলের শিকার হতে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউন্সিল ও দল পুনর্গঠনের বিষয়ে কথা বলে দুই নেতাকে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হওয়ায় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মহাসচিবের কাছে বিভিন্ন কাজের জবাবদিহিতাসহ দাবি নিয়ে কর্মীরা যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিনিয়র নেতারা একে অপরকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন তাদের কিছু করণীয় নেই। সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে হচ্ছে।

সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা যেমন তেমন, সবচেয়ে বেশি চাপে আছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের চরম এই বিপর্যয়ের জন্য অনেকে তাকে দায়ী করছেন। কেন নির্বাচনে অংশ নেয়া হলো, ঐক্যফ্রন্টকে কেন প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি কেন দেয়া হচ্ছে না এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। শুধু দলীয় ফোরাম বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনাতেই নয়, প্রকাশ্যেই নেতাকর্মীরা তার কাছে জবাব চাচ্ছেন।

এছাড়া নয়াপল্টনে থেকে দলকে গতিশীল রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করা দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছেও নানা দাবি নিয়ে কর্মীরা যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো নেতাকর্মীরাই সন্তুষ্ট হওয়ার মতো জবাব পাচ্ছেন না তাদের কাছ থেকে।

বিএনপি সূত্রমতে, যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হওয়ার পরও কেন সিনিয়র নেতারা কিছু বলতে পারছেন না, এজন্য তৃণমূলে প্রশ্ন উঠেছে বিএনপি আসলে চালাচ্ছে কে? কেউ বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাই দল চালাচ্ছেন। কেউ বা বলছেন, তারেক রহমান দলের মহাসচিবের সঙ্গে সমন্বয় করে বিএনপি চালাচ্ছেন। এমন গুঞ্জনও উঠেছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার সবেচেয়ে আস্থাভাজনদেরই দিয়েই দল চালাচ্ছেন। এ জন্য সিনিয়র নেতারা কিছু জানছেনও না, বলতেও পারছেন না। বলতে গেলে অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকছেন সিনিয়র নেতারা।

দল পরিচালনা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের নানা আলোচনা থাকলেও শীর্ষ নেতারা অবশ্য প্রকাশ্যে তা বলতে চান না। বিএনপি পরিচালনার ধরন প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বসেই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য ভালো-মন্দ সব কিছুর দায় স্থায়ী কমিটির সবার।

কদর চায় ২০ দল
অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রাখতে না পেরে মিত্রদের খবরও রাখছে না। এ অভিযোগ ২০ দলীয় জোটের শরিকদের। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্ট নয়, ২০ দলকে সামনে রেখে বিএনপিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে জোটের মিত্ররা। প্রয়োজেনে ২০ দলের সংস্কার করে হলেও সম্মানের সঙ্গে কদর নিয়ে রাজনীতি করতে চায় ২০ দলীয় জোটের শরিকরা।

১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি। পরে জাতীয় পার্টি নিয়ে এরশাদ সরে গেলে শূন্যস্থান পূরণ করে নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।

২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১২টি মিত্রদলকে যুক্ত করে ১৮ দলীয় জোট করে বিএনপি। পরে চার শরিক নিয়ে খন্ডিত হলেও কালের আবর্তে ১৮ দলে রূপ নেয় ২০ দলীয় জোটে। গত নির্বাচনে শরিক বাড়াতে ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের নতুন প্লাটফর্ম গঠন করে বিএনপি, যার নেতৃত্ব দেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ঐক্য মজবুত করার আশায় নতুন-পুরনো এমনকি ভিন্ন আদর্শের কারো কারো হাতে বিএনপি তুলে দেয় নিজদলীয় প্রতীক ধানের শীষও। আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত এই জোটের শরিকদের দাবি-দাওয়া মেটাতে নিজের স্বার্থ উৎসর্গ করেছিল বিএনপি। দলের বাঘা বাঘা নেতাদের রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে সেখানে শরিকদের পুনর্বাসিত করা হয়।

বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদে অংশ নেয় দুই জোটকে সঙ্গে নিয়েই। দীর্ঘদিনের জোট ২০ দলকে হাতে রেখে গত বছরের অক্টোবরে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনেও এই নতুন জোটের নামেই বিএনপি ও ২০ দল অংশ নেয়। তবে ২০ দলকে ৪০টি আসন এবং ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসনে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। কিন্তু পুরো জোটে বিএনপি পায় ৬টি আসন এবং গণফোরাম পায় ২টি আসন। বিএনপি ছাড়া ২০ দলের অন্য কোনো শরিক দল কোনো আসন থেকে জয় পায়নি। ফলে বিএনপির পাশাপাশি দুই জোটেই নেমে আসে চরম হতাশা। নির্বাচনের পরে হতাশার মধ্যেই বিএনপি ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখে সাদামাটা কিছু কর্মসূচি পালন করলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ২০ দল।

নির্বাচনের পরে ২০ দল নিয়ে নামমাত্র ২/১টি বৈঠক করলেও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছে দফায় দফায়। পাশাপাশি এই জোটের সঙ্গে একের পর এক কর্মসূচিও করছে। যুগ যুগ ধরে বিএনপির সঙ্গে থাকা মিত্ররা নতুন গঠিত ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে এই ‘মাতামাতি’ পছন্দ করছেন না। তারা নিজেদের সম্মান ও কদর চাচ্ছেন রাজনৈতিক জোটে।

সর্বশেষ সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়। বৈঠকে ২০ দলের নেতারা সরকারবিরোধী রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা ও ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকার তুলনামূলক ব্যাখ্যাও দেন।

নির্বাচন-পরবর্তী জোটের রাজনীতির বিষয়ে ২০ দলের অন্যতম দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ঐক্যফ্রন্টও বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করেছে, ২০ দলও করেছে। বিএনপির ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি এবং ২০ দলীয় জোটকে এড়িয়ে চলা তাদের ভালো লাগছে না।

তিনি বলেন, এটা দীর্ঘদিনের জোট। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ দলের মধ্যে সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। ২০ দলের মধ্যে পর্যালোচনা করে অনিবন্ধিত ও যাদের তেমন কোনো অবস্থান নেই, তাদের বাদ দিয়ে সংস্কার করা দরকার। তিনি বলেন, এখানে অনেক দল আছে, যারা নামসর্বস্ব। আবার অনেক দল আছে, যারা ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে আছে।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours