বিএনপিতে অনুশোচনা, আন্দোলনের সময় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

1 min read

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে রোডমার্চের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা বিরোধী দলগুলো। তবে রোডমার্চের ধরন নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুটি অংশ সৃষ্টি হয়েছে। বড় অংশটি চাইছে আগামী কোরবানির ঈদের পর আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া। তুলনামূলক ছোট কিন্তু প্রভাবশালী অংশটি মনে করছে—ঈদুল আজহার আগেই সরকারকে দাবি মানাতে বাধ্য করতে আন্দোলন চূড়ায় নেওয়া দরকার। গত কয়েক দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, সিনিয়র একাধিক নেতা ও বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ও যুগপতে যুক্ত বিরোধী দলগুলোর নেতারা জানান, সরকার পতনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত কর্মসূচি নির্ধারণ প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক ইস্যুতে প্রাথমিক কিছু কর্মসূচির পাশাপাশি চলতি মাসের শেষ দিকে রোডমার্চ পালন করবে বিরোধী দলগুলো। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে অন্যান্য বিভাগে রোডমার্চ করবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। জুনের শেষ দিকে চূড়ান্ত রোডমার্চ ঢাকামুখী করার পরিকল্পনা রয়েছে নেতাদের।

এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা আন্দোলনের উত্তাপটাকে মানুষের অংশগ্রহণে বাড়িয়ে তুলতে চাই। আন্দোলনের ফোর্স ঠিক করবে কখন ঢাকামুখী কর্মসূচি হবে। ধারাবাহিক কর্মসূচির ভিত্তিতে মানুষকে আন্দোলনের যুক্ত করার বিষয়টিই আমাদের প্রধান বিবেচনায় রয়েছে।’

বিএনপি ও যুগপতে যুক্ত নেতারা বলছেন, রোডমার্চ ঢাকা থেকে অন্যান্য বিভাগ নাকি অন্যান্য বিভাগ থেকে ঢাকামুখী করা হবে—এ নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুটি অংশের সৃষ্টি হয়েছে। স্থায়ী কমিটির একটি বড় অংশ চাইছে, আগামী কোরবানির ঈদের পর কর্মসূচি চূড়ায় নেওয়া, অন্য প্রভাবশালী অংশটি মনে করছে, ঈদুল আজহার আগেই আন্দোলন চাঙা করে দাবি মানানো।

এক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতার মন্তব্য, ‘ঈদুল আজহার পর কর্মসূচিতে গেলে সেটা হবে আগস্ট মাস। শোকের মাসে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সুবিধা পেলে আন্দোলন থমকে যাবে। এজন্য গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিএনপির ভেতরের প্রভাবশালী একটি অংশ চেয়েছিল—মে ও জুনের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করে ফলাফল ঘরে আনা।’

এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আন্দোলনের চূড়ান্ত সময় নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে ডিভিশন আছে। মেজরিটি অংশ চাইছে ঈদুল আজহার পর কর্মসূচি চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া। আবার কেউ কেউ চাইছেন ঈদুল আজহার আগে চূড়ান্ত কর্মসূচি পালন করা। কারণ, ডিসেম্বরে যদি নির্বাচন হয়, সেক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী, তিন মাস আগে সেপ্টেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচনি আবহ সৃষ্টি হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঈদের আগেই আন্দোলন চূড়ায় নেওয়ার পক্ষে ছিলাম।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কর্মসূচি কখন আসবে—সেটা নির্ধারণ হলে আমরা জানিয়ে দেবো।’

বিএনপির আরেকজন নেতা জানান, মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটির সভা আছে। সভায় যৌথ রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। সব দল একসঙ্গে বসে যৌথ রূপরেখা ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ও দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় সংসদ থেকে দলীয় ছয় জন এমপির পদত্যাগের পর গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় শেষ সমাবেশ নিয়েও এবার দলের মধ্যে অনুশোচনা কাজ করছে।

স্থায়ী কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলেন, ‘আমাদের বিভাগীয় সম্মেলনগুলো অনেক আর্লি হয়ে গেছে। এটা এখন সবাই বুঝতে পারছেন। দ্বিতীয়ত, ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করতে সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দেওয়ার পর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করা বড় ভুল ছিল। এসব ভুলের অনুশোচনা হচ্ছে।’

গণতন্ত্র মঞ্চের ‍দুই জন নেতা এ প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশ করা ছিল এযাবৎকালের বাজে সিদ্ধান্ত। একটা পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা ও সুযোগ বিএনপি নষ্ট করেছে নয়া পল্টনে না গিয়ে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও ওই পরিস্থিতির একটা রূপ দেখতে চেয়েছিল।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করতে চাননি মির্জা আব্বাস এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। তারা না চাইলেও দলের হাইকমান্ড একাধিক সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে গোলাপবাগ মাঠকে বেছে নেওয়া হয়।’

‘এই দুই হিসাবে ভুল করে আমরা এখন হিসাবে আরও সতর্ক’, উল্লেখ করেন স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। তিনি বলেন, ‘এ জন্যই এখন থেকে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব যুগপতে যুক্ত বিরোধী দলগুলোর পরামর্শ নেওয়া হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

দলের দায়িত্বশীল একজন নেতা জানান, ঢাকা থেকে অন্যান্য বিভাগমুখী রোডমার্চ নিয়ে তৃণমূলে যথেষ্ট বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে মানুষ ও দলের অনুসারীদের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় নেতাদের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে আবারও বিভাগীয় কর্মসূচির চাপ কতটা বাস্তবসম্মত হবে- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। এমনকি তৃণমূল থেকে এখনও এই বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এই দায়িত্বশীল।

বিএনপির আরেক দায়িত্বশীলের ভাষ্য- মূল মনোযোগ দেওয়ার কথা রাজধানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। অথচ এই মূল জায়গাতেই এখনও কৌশল নির্ধারণ করতে পারেনি বিএনপি।

গণতন্ত্র মঞ্চের দুই জন শীর্ষ নেতা জানান, বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজোঁ কমিটি মিলে ‘সরকার ও শাসন ব্যবস্থা বদলের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সাত দফা’ চূড়ান্ত করার পর এবার দ্বিতীয় দফায় আবারও যৌথ খসড়া ঘোষণাপত্র করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। সোমবার (৮ মে) রাতে যেকোনও সময় বিএনপির কাছে এই যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া পৌঁছানো হবে।

মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে আভাস পাওয়া গেছে, গত ১৩ এপ্রিল বিএনপির পক্ষ থেকে আকস্মিকভাবে ২৭ দফাকে কেন্দ্র করে যৌথ ঘোষণার প্রস্তাব আনা হয়। এরপরই দ্বিতীয় খসড়ার কাজ শুরু করেন মঞ্চের নেতারা।

সোমবার মঞ্চের প্রভাবশালী একজন নেতা জানান, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে ২৭ দফা, ওই বছরের ৮ আগস্ট গণতন্ত্র মঞ্চ ১৪ দফা, ১৮ ফেব্রুয়ারি গণসংহতি আন্দোলনের ১৪ দফা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ অপরাপর বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে দ্বিতীয়বারের মতো খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

আরেক নেতা উল্লেখ করেন, অন্তত ৩০-৩৫ দফার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours