নদীর জায়গা পুনরুদ্ধারে মাঠে নেমেছে সরকার

1 min read

নিউজ ডেস্ক: ‘এই যে এখানে আপনি বসে আছেন, এ জায়গাটিও নদীর ভেতর ছিল। চৈত্র মাসেও অন্তত ৩০ ফুট পানি থাকত এখানে।’ লালবাগের কেল্লার মোড়ে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে চায়ের দোকানে বসে আদি বুড়িগঙ্গার স্মৃতিচারণা করছিলেন মধ্যবয়সী মুসলিম মিয়া।

এখানে যে একটা নদী ছিল, সেখানেও লঞ্চ চলত, এ এলাকায় তাঁর বয়সী মানুষের কাছে তা এখনো রূপকথার গল্প হয়ে যায়নি। আশির দশকের শেষ দিকে বেড়িবাঁধ তৈরির পর থেকে কিভাবে এ শাখা নদী তাদের চোখের সামনেই প্রায় বিলীন হওয়ার পথে সেই শোকগাথায় যোগ দিলেন মোহাম্মদ লোকমানও। বেড়িবাঁধের ভেতরের অংশে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) দুটি বড় এক্সকাভেটর ভেঙে চলছিল একের পর এক স্থাপনা। ততক্ষণে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে পাশাপাশি দুটি দোতলা ভবন, বেশ কয়েকটি টিনের ঘর, অস্থায়ী দোকানপাট।

বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যেই এ রকম অভিযান চালায়, কিছু স্থাপনায় আঁচড় লাগে, আংশিক ভাঙা পড়ে, আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় স্বমহিমায়। তবে ২৭ জানুয়ারি এ অভিযান শুরু হওয়ার পর ভিন্ন বার্তা পেল স্থানীয় মানুষ। তাদের বিশ্বাস, এ অভিযান আগেরগুলোর মতো নয়। তারাও এখন বিশ্বাস করছে, ক্ষীণ স্রোতের বুড়িগঙ্গাও জেগে উঠবে আবার, এখানে আধুনিক জেটি হবে, আবার ভিড়বে আন্ত জেলা লঞ্চ ও স্টিমার।

কারো কারো স্বপ্ন আরো বিস্তৃত—নদীর পার ঘেঁষে চলে যাবে রেললাইন, যুক্ত হবে পদ্মা সেতুর সঙ্গে।

বুড়িগঙ্গার পার ধরে সোয়ারিঘাটের পর কামালবাগ, বাগানবাড়ী, কিল্লার মোড়, শ্মশানঘাটে পর পর দুই দিনের অভিযানে আংশিক বা পুরো ভাঙা হয়েছে সারি সারি ভবন, টিনের ঘরসহ নানা স্থাপনা।

বৃহস্পতিবার সপ্তম দিনের অভিযান চলার সময় নদীর দুই পারে, কামরাঙ্গীর চর লোহার ব্রিজের ওপর উত্সুক মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছিল দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা স্থাপনা কিভাবে চোখের সামনেই মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। ছোট ছোট জটলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল কেউ কেউ। ‘খুবই ভালো উদ্যোগ’, ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল।

‘এবার আর কেউ রক্ষা পাবে না’, বললেন জুলহাস মিয়া। তিনি জানান, আগে কয়েকবার নোটিশ দিয়েছে, মাইকেও ঘোষণা দিয়ে সরে যেতে বলা হয়েছে, তারপর অভিযান চালানো হচ্ছে। ছোট একটা দুই-আড়াইতলা ভবনের গায়ে ‘ছৈয়দ সফিউর বশর আল-মাইজভাণ্ডারি রওজা শরিফ’ লেখাটি ঝাপসা হয়ে গেছে। বিআইডাব্লিউটিএর খননযন্ত্রটি তখন ভবনের পেছনের দিকটায় ক্রিয়াশীল।

অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিআইডাব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন। তিনি বললেন, ‘আমরা নদী দখলকারীদের এ বার্তা পরিষ্কারভাবে দিতে চাই যে আপনারা সরে যান।’ এটি যে আগের অভিযানের মতো ‘রুটিন ওয়ার্ক’ নয়, তা স্পষ্ট করে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘এ রকম ম্যাসিভ অভিযান এর আগে হয়নি। এ চ্যানেল ধরে আমরা গাবতলী পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের লক্ষ্য বুড়িগঙ্গার সঙ্গে তুরাগের সংযোগ পুনঃস্থাপন করা।’

নদীর জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি স্থাপনাগুলো ‘সমূলে উৎপাটন’ করতে হচ্ছে বলে প্রতিদিনের অভিযানে ধারণার চেয়েও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে, তাই কত দিন লাগবে তা বলতে পারলেন না ওই কর্মকর্তা। তাঁর সন্দেহ, অভিযানের মধ্যেও ভবনের ‘রাবিশ’ (ভাঙা কংক্রিটের টুকরো) ফেলে ভরাট করার প্রক্রিয়া চলছে। ‘এই দেখুন, নতুন করে রাবিশ ফেলেছে। দেখেই মনে হচ্ছে, গত রাতেই ফেলা হয়েছে এগুলো।’ তাঁর সঙ্গে থাকা এক কর্মকর্তাকে তখনই নির্দেশ দিলেন, এলাকার বাসাবাড়ির ময়লা ট্রলিতে করে যারা আনে সেই পরিচ্ছন্নকর্মীদের ওপর নজর রাখতে। পাশ থেকে একজন যোগ করলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকেও ময়লার পাশাপাশি রাবিশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। অবৈধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের পাশে আগে থেকেই স্তূপীকৃত রাশি রাশি আবর্জনার বস্তা দেখিয়ে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘এগুলোই বা কী করব! এগুলো যথাস্থানে ফেলা, রিসাইক্লিং করার কাজ তো সিটি করপোরেশনের।’

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরের পাশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে আদালতের নির্দেশনা এসেছে একাধিক রায়ে। বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও ধারাবাহিকতা থাকেনি। এবারের অভিযানের বাড়তি শক্তি তাহলে কী? বিচারিক সদিচ্ছার সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আর তার কঠোর বার্তা পেয়ে তৎপর হয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন নদীর সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠন ‘নোঙ্গর’-এর সভাপতি সুমন শাম্স। তিনি বলেন, ‘এবারের অভিযান শুধু আঁচড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার মতো হবে না। আসলে রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। নদী রক্ষার কথা আমরা তো বলেই যাচ্ছি, উচ্চ আদালতের রায়ও আছে এ নিয়ে। এবার যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতেও আছে নদী রক্ষার কথা।’

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে একের পর এক স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে, নদীর দুই পারে দাঁড়িয়ে থাকা উত্সুক মানুষের সঙ্গে মিশে আছে স্থাপনার মালিক ও ভাড়াটেরা। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা আসবাবের ওপর বসে ছিলেন এক ভাড়াটে। মৃদু কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমাদের মালপত্র নষ্ট হলো। আমরা তো ভাড়া দিয়ে থাকি। আমাদের কী দোষ!’

ভিড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে এলেন একজন, নাম বললেন এইচ এম আশরাফ। একটু আগেই এক্সকাভেটর ধসিয়ে দিয়ে গেছে টিনের বেশ কয়েকটি চালাঘর। সেখানে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র দেখিয়ে বললেন, ১৯১২ সাল থেকে এ জমির মালিক তাঁরা। সঙ্গে থাকা একজন সার্ভেয়ার নকশা দেখিয়ে বললেন, এই ৪২ দাগে ৭৬ শতক জমি ব্যক্তিমালিকানার, ডিসি অফিস থেকে কাগজপত্র আছে, কোর্টের রায়ও আছে। অথচ কেউ তাঁর কথা শুনছে না।

অভিযানে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনেই নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদের এ অভিযান। হালনাগাদ স্থগিতাদেশ কেউ দেখালে আমরা সেখানে অভিযান চালাচ্ছি না।’

সক্রিয় হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও। সরকারি এ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার অখিল কুমার বিশ্বাস বৃহস্পতিবার অভিযানস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘বেড়িবাঁধের পাশে আমাদের অধিগ্রহণ করা জমি আছে। সেগুলো চিহ্নিত করে এ উচ্ছেদ অভিযানে আমরাও সহযোগিতা করছি।’

তৎপরতার মধ্যে খানিকটা আশঙ্কারও আভাস পাওয়া গেল কর্মকর্তাদের আলাপ-আলোচনায়। কখন কে আবার আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে, তাহলে থমকে যাবে সব আয়োজন।

নদী রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ২০০৯ সাল থেকেই রয়েছে, বিআইডাব্লিউটিআইসহ বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়েছিল, তাহলে এবারেরটা আলাদা কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বললেন, ‘এ রকম স্কেলের (ব্যাপ্তি) উচ্ছেদ অভিযান ঢাকাবাসী এর আগে কখনো দেখেছে বলে আমার জানা নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে সরকার। নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের রাজনৈতিক অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়েছে। নদীর জমি, সরকারি জমি জবরদখল করাও বড় ধরনের দুর্নীতি। এটা আমরা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি।’

উচ্চ আদালতের আগের রায় তো ছিলই, নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেওয়া সাম্প্রতিক রায় এ দায়িত্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখন নদীও বিচার চাইতে পারে। বলতে পারে, আমাকে বাঁচাও। এটিকেও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।’

আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধারের চলমান অভিযানের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে কমোডর মোজাম্মেল বলেন, ‘সিএস/আরএস খতিয়ানে আদি বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য তুরাগ পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার। এখন লোহারপুলের একটু পর পর্যন্ত দুই-আড়াই কিলোমিটার আছে, এরপর নেই। আমরা একটা সার্ভে করিয়েছি। সেটি উচ্চ আদালতে উপস্থাপন করব। আদেশ পেলে সেই অনুসারে উদ্ধারকাজে এগোব।’ ১৯২৪, ১৯৪৩, ১৯৬৭ সালের ম্যাপে আদি বুড়িগঙ্গা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন বড় অংশজুড়ে বড় বড় ভবন। কিভাবে নদীর জমি লিজ দেওয়া হলো? সেই জমি আবার বিক্রি হলো? লিজের জমিতে কিভাবে স্থায়ী কাঠামোর অনুমোদন দেওয়া হলো?’ উদ্ধারের পর কী পরিকল্পনা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদি বুড়িগঙ্গা উদ্ধার প্রকল্প নামক একটি প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছি আমরা। এখন উদ্ধারটাই আমাদের অগ্রাধিকার।’

বিআইডাব্লিউটিআইয়ের চেয়ারম্যান বলেন, দখলমুক্ত করার অভিযান বুড়িগঙ্গায়ই সীমিত থাকবে না, পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই নদীর যেখানে যেখানে দখল আছে, তা উদ্ধার করতে অভিযান চালানো হবে। এ রকম অভিযান চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে চলছে, খুলনায় হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours