হাওরে পরিযায়ী পাখি শিকারের মহোৎসব

1 min read

নিউজ ডেস্ক: মৌলভীবাজারের হাকালুকি এবং হাইল হাওরের বাইক্কাবিলসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে পরিযায়ী ও দেশীয় পাখি শিকারের মহোৎসব। বিষটোপ, শিকারের জাল এবং বিভিন্ন অভিনব উপায়ে পাখি শিকার করছে অবাধ্য শিকারিরা । শিকার করা এসব পাখি চলে যাচ্চে বিভিন্ন রিসোর্ট, হোটেলসহ বিত্তশালীদের ঘরে। এর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন বাজারে মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে এসব পাখি ।

অবৈধভাবে পাখি বিক্রি ও শিকারের ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বনবিভাগ বা প্রশাসনের কাছে পাখি শিকারিদের তথ্য অজানা থাকলেও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তাদের তথ্য।

মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের সংরক্ষিত এলাকা বাইক্কাবিল। এ বিলে এ বছর প্রায় ১১ হাজার পাখির দেখা মিলেছে। পাখি শুমারি করে এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি রাতে এ হাইল হাওরের বাইক্কাবিলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত পাখি শিকার করা হচ্ছে। বাইক্কাবিলে পাহারার ব্যবস্থা থাকলেও এ বিলের পাখি মূলত সারা হাইল হাওরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এই হাওরকে ঘিরে বসবাসকারী এবং মৎসজীবীরা রাতের আঁধারে মাছ ধারার সঙ্গে পাখি শিকার করছেন। পাখি শিকার তাদের কাছে মৌসুমী ব্যবসা। রাতের আঁধারে পাখি শিকার করে সেই পাখি ভোরে বস্তা ভরে বা মাছের ডোলার ভেতরে করে নিয়ে যাচ্ছেন হাওরের পাশের লোকালয়ে । মোবাইল কলের মধ্যে নির্দিষ্ট কাস্টমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে গন্তব্যে। অনেক সময় আবার মোটরসাইকেল বা সিএনজি নিয়ে পাখির ক্রেতারা তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন।

বৃহস্পতিরার ভোরে হাজীপুর গ্রামের সনর মিয়া প্রায় ৫০টি মৃত পাখি (বিষটোপ দিয়ে শিকার করা) মাছের ডোলার ভেতরে করে নিয়ে আসেন বরুনা বাজারে। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে আসা আগে থেকে ঠিক করে রাখা কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেন তিনি। হাজীপুর গ্রামের শুধু সনর মিয়া নয় অনুসন্ধানে এই গ্রামের বেশ কিছু জেলে পাখি শিকারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে । তার মধ্যে নিয়মিত সক্রিয় শিকারি জামান মিয়া, বাহার আলী, জসিম উদ্দিন, আকলিম উদ্দিন এবং পার্শ্ববর্তী বরুণা গ্রামের সাদিক মিয়া।

অভিযোগ আছে বাইক্কাবিলের যে জনবসতি গড়ে উঠছে সে হাজিপুর গ্রামের ৯০% ঘরের চলছে পাখির মাংসের মহোৎসব। বিলের একেবারে সন্নিকটে তাদের বাড়ি হওয়ায় পরিযায়ী পাখিরা এমনিতে তাদের বাড়িতে আসে। তাই তাদের জন্য বাড়িতে বসেই বা বিলে গিয়ে শিকার করা খুব সহজ।

বাইক্কা বিলে পাখি ক্রয় করা কতটা সহজ তার প্রমাণ মিলে বিলের পাশ্ববর্তী হাজিপুর গ্রামের কয়েকজন যুবকের সঙ্গে কথা বলে। নিজেকে একটি রিসোর্টের মালিক পরিচয় দিয়ে গোপনে পাখি কেনা যাবে কি-না চানতে চাইলে তারা জানালেন পাখি কিনতে হলে আগে জানিয়ে রাখতে হবে। টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গেলে পাখি শিকারের পর মোবাইলে জানানো হবে তখন এসে নিয়ে যাবেন।

বাইক্কবিলের রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশনের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিটা মানুষ যেভাবে পারছে পাখি শিকার করছে। অনেক ক্ষেত্রে রক্ষক এখানে ভক্ষক।

একই অবস্থা দেশের বৃহত হাওর হাকালুকিতে। এ বছর গত দুই বছর আগের তুলনায় ২০ হাজার পাখি কম এসেছে । চলতি মাসের ২৬ এবং ২৭ জানুয়ারি পাখি শুমারি করতে গিয়ে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু হাকালুকি হাওরে বিষটোপ দিয়ে মারা বেশ কিছু পাখি দেখতে পান।

এর তিন দিন পর ৩০ জানুয়ারি হাকালুকির দুধাই বিলের পাড়ে শিকারিদের বিষটোপের কারণে খামারি সামছুল ইসলামের ৩০০টি হাঁস মারা যায়।

সামছুল ইসলামের অভিযোগ, খুঠাউরা গ্রামের দুধু মিয়া, মনাফ মিয়া, সুনাই মিয়া, মনা মিয়া, আনোয়ার হোসেন, ওয়াতির আলী, ছালিক আহমদ, আছাদ উদ্দিনসহ বড় একটি সিন্ডিকেট প্রতিদিন হাওরের বিভিন্ন বিলে ধানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে অতিথি পাখি নিধন করছেন। পাখি শিকারের জন্য ধানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রাখায় সে বিষটোপ খেয়ে তার হাঁস মারা গেছে।

অন্যদিকে মৌলভীবাজারসহ সিলেটের বিভিন্ন মহাসড়কে প্রকাশ্যে চলছে পাখি বিক্রি। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের শেরপুর থেকে হবিগঞ্জের মিরপুর এলাকা পর্যন্ত মহাসড়কে প্রাইভেট কারের যাত্রীদের লক্ষ্য করে প্রতিদিন শত শত পাখি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অবৈধ পাখি বিক্রেতারা। হাইওয়ে পুলিশ দেখেও অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে। সে পাখি বেশ চড়া দামে কিনে নেন বিত্তশালীরা।

বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু জানান, হাকালুকি হাওড়ে মানুষের লোভ আর মূর্খতার প্রমাণ দিয়েছে বিষটোপ দিয়ে মারা কয়েক জাতের বুনো হাঁসের মরদেহ। এই হাঁস যারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বাসায়, সঙ্গে নিজের মৃত্যু পরোয়ানাও কিনছেন।

বিভাগীও বন কর্মকর্তা (প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ) আবু মুসা সামসুল মোহিত চৌধুরী জানান, আগের থেকে পাখি শিকার অনেক কমেছে । আমাদের লোকবল সংকট তবুও আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। মানুষকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মানুষের সচেতনতাই পারে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে ।

আরও পড়তে পারেন

+ There are no comments

Add yours